23 Nov 2024, 04:50 am

ঝিনাইদহের ৬টি বাওড়পাড়ের মৎস্যজীবীদের আহাজারী ; “হয় বিষ দেন না হলে বাওড়ের মালিকানা দেন”

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

জাফিরুল ইসলাম : কোটচাঁদপুরের বলুহর প্রজেক্ট পাড়ার ৭৭ বছর বয়সী শ্রী নরেণ হালদারের ৬৮ বছরই কেটেছে জাল দড়া টেনে। পাকিস্তানী আমল থেকে তিনি বাওড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও বৃহৎ একটি পরিবার তার আয়ের উপর নির্ভরশীল। জীবন সয়াহ্নে এসে তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন বলুহর বাওড়ের মালিকানা হারাতে বসেছে। জেলা প্রশাসন টেন্ডারের মাধ্যমে বাওড়গুলো ইজারাদানের পক্রিয়া চালাচ্ছে। ফলে কর্ম হারানোর প্রহর গুনছেন বাওড়পাড়ের হাজারো মৎস্যজীবী পরিবার। শুধু নরেণ হালদার নয়, তার মতো বাওড় পাড়ের সুধীর হালদার, নিত্য হালদার ও শ্রীমতি কমলা হালদারসহ জেলার ৬টি বাওড়ের উপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ হাজার মানুষের মাঝে নেমে এসেছে চরম হতাশা। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, সরকারের ভুমি মন্ত্রনালয় ঝিনাইদহের ৬টি বাওড় ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাওড়গুলো হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঠগড়া, ফতেপুর, কোটচাঁদপুরের বলুহর, জয়দিয়া, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং বেড়গোবিন্দপুর। এ সব বাওড়ের মোট জলাকার ১১৩৭ হেক্টর। ৭৬৭টি পরিবারের প্রায় ৫ হাজার সদস্য জীবিকা নির্বাহ করে। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন থেকে এ সব বাওড়ের দরপত্র আহবান করা হয়েছে। অথচ মৎস্যজীবীরা সরকারের “জাল যার জলা তার” এই নীতির উপর ভর করে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বাওড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। সুফলভোগী মৎস্যজীবী সুধীর হালদার জানান, বর্তমানে বাওড়গুলো বিল ও বাওড় মৎস্য উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এতে তাদের ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। বাওড়ের মাছ ধরার কাজ তারাই করেন। আর ইজারা দিলে সরকারের এককালীন বেশি টাকা আয় হলেও একদিকে যেমন বাওড়গুলো ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনি মালিকানা হারিয়ে পথে বসবে বাওড়ের উপর নির্ভরশীল হাজারো পরিবার। ফলে ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। বাওড়গুলো চলে যাবে প্রভাবশালী মধ্যসত্বভোগীদের দখলে। মালিকানা হারিয়ে মৎস্যজীবীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। মাছ চাষে সার-ঔষধের ব্যবহারে বাওড় থেকে রাণী মাছ চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে। বাওড়গুলোকে ঘিরে সরকারের যে লোকবল রয়েছে, তারাও হবে বেকার। কোটি কোটি টাকার ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে একটি মাফিয়াচক্র বাওড়গুলো ইজারা নিতে কোমর বেধে মাঠে নেমেছে। ভুইফোড় সমিতির নামে কোটি কোটি টাকার ডাক তুলে সিডি জমা দেয়া হয়েছে। কোটচাঁদপুরের শীতল হালদার নামে এক ব্যক্তি দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিপরীতে সিডি জমা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই টাকার জোগানদাতা কারা ? সুধীর হালদার বস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, হালদার সম্প্রদায় জেলা প্রশাসক মনিরা বেগমের সঙ্গে দেখা করে বলে এসেছেন “হয় বিষ দেন না হয় বাওড়ের মালিকানা দেন”। বলুহর বাওড় ইজারা দেয়া হলে তারা সেচ্ছায় আত্মহুতির কর্মসুচি দিতে বাধ্য হবেন। বলুহর বাওড় পাড়ের বাসিন্দা পাগল চন্দ্র হালদারের স্ত্রী রাধা রানী হালদার জানান, বলুহর প্রজেক্টপাড়ায় ৪০৪টি পরিবার রয়েছেন যারা বাওড়ে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করেন। তার পরিবারের ২০/২৫ জন সদস্য এই মাছের উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ৯ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। এখন তার বয়স ৭৩ বছর। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছেন শ্বশুর, স্বামী ও সন্তানরা বলুহর বাওড়ে মাছ ধরে জীবন বাচাচ্ছেন। এখন শুনছেন সরকার বাওড় ইজারা দিচ্ছে। তার স্বজনরা বেকার হয়ে যাবে। অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, ৬ টি বাওড়ে নিদৃষ্ট অংকের মাছ ছাড়া হয়। প্রতি বছর মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। বাওড়ের কর্মরতরা এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন করে থাকেন।

এই মাছ চাষের মাধ্যমে বাওড় পাড়ের হালদারদের জীবন-মান উন্নত করতে বাওড়ে যে মাছ থাকবে তার ৬০ শতাংশ সরকার, আর ৪০ শতাংশ হালদাররা পেয়ে থাকেন। এছাড়া বাওড়ের পানিতে যে ছোট ছোট দেশিয় মাছ থাকে তা সবই হালদারদের প্রাপ্য। তারা এই মাছ বিক্রি করে অর্থ উপার্যন করেন। এভাবে একদিকে সরকার মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা পুরণ করছে, অন্যদিকে বাওড় পাড়ের হালদারদের জীবন-মান উন্নয়ন করে যাচ্ছিলেন। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল ভুমি মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সমঝোতা চুক্তি শেষ হচ্ছে। এই চুক্তি শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পরিবর্তে বাওড়গুলো ইজারা দেওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ২২ সালের ডিসেম্বর বাওড়গুলো ইজারা দরপত্র আহবান করা হয়েছে। ইজারায় মধ্যসত্বভোগী কোটিপতিরা অংশ নিচ্ছেন। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মোঃ আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছে বর্তমান প্রকল্পের মেয়ার বৃদ্ধি করে চলমান নিয়মে মাছের চাষ করা। কিন্তু ভুমি মন্ত্রনালয় এগুলো ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা চুড়ান্ত ভাবে বাস্তবায়িত হলে হাজারো হালদার পরিবার পথে বসবেন। মৎস্য বিভাগেরও অনেকে বেকার হয়ে যাবেন। এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, বাওড়পাড়ের মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে ভুমি মন্ত্রনালয় মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষের জন্য দিয়েছিল। কিন্তু তারা সফলতা আনতে পারেনি। যে কারনে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাওড়পাড়ের হলদারদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবেন বলে জানান। বিষয়টি নিয়ে কোটচাঁদপুর মহেশপুর এলাকার সংসদ সদস্য এ্যাড শফিকুল আজম খান চঞ্চল জানান, আগামী ৩১ জানুয়ারি বিষয়টি নিয়ে আন্তঃ মন্ত্রনালয়ে সভা হবে। সেখানে বিষয়টি উঠবে। তিনি বলেন, বাওড়গুলো ইজারা দিলে সরকার হয়তো এককালীন টাকা পাবে কিন্তু হালদার পরিবারগুলো কোথায় যাবে ? এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মানবতা ভুলুন্ঠিত হবে বলে তিনি মনে করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 8591
  • Total Visits: 1273961
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২০শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, ভোর ৪:৫০

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018